আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা লাভের অন্যতম পীঠস্থান হল সুইডেন। উন্নত জীবন, পড়াশুনা, এবং গবেষণার অপার সমাহার রয়েছে এই দেশটিতে। আর এসব কারণেই উচ্চ শিক্ষা পিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে সুইডেন।
সুইডেন ইউরোপের অন্যতম অত্যাধুনিক দেশ। এ দেশের মুদ্রার নাম ক্রোনা। এ দেশে শিক্ষার হার ৯৯%। শিক্ষার্থীদের এই পছন্দের ডেস্টিনেশন নিয়ে আপনাদের সামনে তথ্য উপাত্ত সহ আমরা আলোচনা করবো সুইডেনে উচ্চশিক্ষার সকল খুটি নাটি বিষয় সম্পর্কে।
সুইডেনের একাডেমিক স্ট্রাকচার ও সেমিস্টার
সুইডেনের শিক্ষা ব্যবস্থা “National Standard of Academic Education” এর অন্তর্ভুক্ত। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রফেশনাল এডুকেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ দেশে অনার্স প্রোগ্রামে সুইডিশ ভাষা জানা থাকলে ভালো- তবে না জানা থাকলেও সমস্যা নেই, কারণ, এ দেশের Second Language হল ইংলিশ।
স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধিকাংশ কোর্স হল ইংরেজী মাধ্যমে অফার করা হয়। প্রায় ৬০০ এর বেশি কোর্স মাস্টার্স প্রোগ্রামে অফার করা হয় এবং সবগুলোই ইংরেজী মাধ্যমে অফার করা হয়।
সুইডেনে ব্যাচেলর প্রোগ্রাম ৩-৪ বছরের, মাস্টার্স প্রোগ্রাম ১-২ বছরের হয়ে থাকে। এদেশে ৬ মাসের ডিপ্লোমাসহ PhD, Post-Doctoral এর সুযোগ রয়েছে। আর আপনি যদি প্রশিক্ষণমূলক পড়াশুনা করতে চান তারও ব্যবস্থা রয়েছে এই দেশে। প্রশিক্ষণমূলক কোর্সসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় “National Agency for Higher Vocational Education” এর মাধ্যমে।
আপনাদের সুবিধার জন্য কিছু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লিস্ট এখানে সংযুক্ত করা হলঃ
- Uppsala University
- KTH Royal Institute of Technology
- Lund University
- University of Gothenburg
- Linkoping University
- Umea University
- Chalmers University of Technology
- Stockholm University
সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুইটি সেমিস্টার রয়েছে- স্প্রিং সেমিস্টার ও অটাম সেমিস্টার
(১) স্প্রিং সেমিস্টার (Spring Semester) শুরু হয় মধ্য জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত। এই সেমিস্টারে আবেদন করা শুরু হয় মে মাস থেকে।
(২) অটাম সেমিস্টার (Autumn Semester) শুরু হয় পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত আর এই সেমিস্টারের আবেদন শুরু হয় মধ্য অক্টোবর থেকে।
এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল স্প্রিং সেমিস্টারে শুধু শর্ট কোর্স (৬ মাস ) অফার করা হয়ে থাকে। তাই এই সেমিস্তারে এপ্লাই করলে সাধারণত আপনি ৬ মাসের ভিসা পাবেন। অন্য দিকে অটাম সেমিস্টারে সাধারণত অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স অফার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনি মাত্র ১৩ মাসের ভিসা পাবেন- যদিও কোর্স ডিউরেশন ৩/ ৪ বছর অথবা ১/২ বছরের হয়ে থাকে। তবে চিন্তার কোন কারণ নেই- আপনি চাইলে আবেদন করে সময় সীমা বাড়িয়ে নিতে পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ হওয়ায় আপনাকে হাতে সময় রেখে মাঠে নামতে হবে।
কোর্স বাছাই ও ভর্তি আবেদন পর্ব
সুইডেনে কেবল একটি ওয়েবসাইট দিয়ে সব বিশ্ববদ্যালয়ে আবেদন করা হয়। এর অন্য কোন উপায় নেই। আপনার সুবিধার্থে লিঙ্কটি নিচে দেওয়া হলঃ
https://www.universityadmissions.se/intl/start
https://www.universityadmissions.se/intl/search
প্রথমে এই ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার নিজের সঠিক তথ্য দিয়ে একটি একাউন্ট খুলতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ও আপনার পছন্দের কোর্সটি বাছাই করতে হবে। মনে রাখবেন, একই তথ্য দিয়ে একাধিক একাউন্ট খুললে সবগুলো একাউন্ট ব্যান হয়ে যাবার সম্ভবনা থাকে। আপনি চাইলে নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব পোর্টাল ঘুরে কোর্স পছন্দ করে এই ওয়েব সাইটে সেটা সিলেক্ট করে দিতে পারবেন।
একটি সেমিস্টারে আপনি ৪ টির বেশি কোর্সে এপ্লাই করতে পারবেন না ।
ভর্তি আবেদন ফি ও কাগজপত্র পাঠানোর উপায়
প্রথমেই বলে রাখি, আবেদনের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ৯০০ ক্রোনা। মূলত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কিন্ত আপনার যদি ক্রেডিট কার্ড নাও থাকে তবে ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমেও এই অর্থ পরিশোধ করা যাবে।
এখন আসি কি কি ডকুমেন্টস পাঠাতে হবে তার ফিরিস্তত নিয়ে। সাধারণত ব্যাচেলর এবং মাস্টার্সের মার্কশীট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্যায়িত করে হার্ড কপি পাঠাতে হবে। এটি আপনি সরকারি ডাক বিভাগ বা DHL এর মাধ্যমেও পাঠাতে পারবেন। আর IELTS স্কোর, মোটিভেশন লেটার (Motivation Letter), পাসপোর্টের কপি, এবং কিছু ক্ষেত্রে সিভি (CV) ইত্যাদির সফটকপি Upload করতে হবে। এই তথ্যগুলো কোর্সের ওয়েবসাইটে সঠিক ভাবে খুঁজে দেখতে হবে। ভুলে করলে একদমই চলবে না।
সুইডিশ না ইংলিশঃ IELTS প্রয়োজন কি না?
IELTS ছাড়া আপনি ভর্তির আবেদন করতে পারবেন যদি আপনার Medium of Instruction হয় ইংরেজী। কিন্তু, মনে রাখবেন IELTS ছাড়া আবেদন করা গেলেও সে ক্ষেত্রে আপনার ভিসা পাওয়ার সম্ভবনা কমে যাবে। তাই আমার ব্যক্তিগত মতামত, IELTS দিয়েই আবেদন করা উচিত। ব্যাচেলর প্রোগ্রামের জন্য 6.0 আর মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য 6.5 স্কোর থাকলে ভালো হয়।
সেমিষ্টার টিউশন ফি ও মাসিক বসবাসের খরচ
বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স ভেদে টিউশন ফি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে বছরে আনুমানিক প্রায় ৮০,০০০ থেকে ১,৪০,০০০ ক্রোনা টিউশন ফি দিতে হবে যদি আপনি সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে চান। এখানে খাওয়া থাকা বাবদ ৫০০০ – ৮০০০ ক্রোনা প্রয়োজন পড়ে প্রতি মাসে। তবে আপনি পার্ট টাইম জব করে সহজেই এই খরচ বহন করতে পারবেন।
আছে স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ
স্কলারশিপ সুইডেনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই দেশে দুই ধরণের স্কলারশিপ প্রদান করা হয়ে থাকে- প্রথমটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং অপরটি দেওয়া হয় সুইডিশ সরকারের পক্ষ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপটি শুধু টিউশন ফি এর উপর দেওয়া হয়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি স্কলারশিপেরও সু্যোগ রয়েছে। এই সরকারি স্কলারশিপে টিউশিন ফি এর পাশাপাশি মাসিক ভাতাও দেওয়া হয়ে থাকে। এটি SI স্কলারশিপ নামে পরিচিত।
নিচে SI স্কলারশিপের লিঙ্ক দেওয়া হলঃ
https://studyinsweden.se/scholarships
মনে রাখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হবার পর এই স্কলারশিপের আবেদন করতে হয় এবং সাধারণত মার্চ মাস থেকে এই আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আর্থিক সচ্ছলতা বা ব্যাংক সলভেন্সি
আপনি যদি এক বছরের জন্য পড়তে চান, তাহলে আপনাকে ৮,১৯০ করে ১০ মাসের খরচ ব্যাংকে রাখতে হবে। আবার যদি দুই বছরের জন্য যান তাহলে আনুপাতিক হারে এই টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকবে। মনে রাখবেন এই অর্থ আপনার নামে ব্যাংকে রাখতে হবে আর ভিসা আবেদনের ৩ মাস আগ থেকে এই টাকা আপনার একাউন্টসে থাকতে হবে। এই ব্যাপারে আরো স্বচ্ছ ধারণা পেতে সুইডিশ এম্বেসীতে যোগাযোগ করতে হবে।
ভিসার জন্য আবেদন
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি নিশ্চিত হবার পর যদি স্কলারশিপ না পেয়ে থাকেন তবে টিউশন ফি জমা দিতে হবে। এরপর টিউশন ফি জমা দেওয়ার পর ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
আপনার সুবিধার্থে চেকলিস্ট করে দেওয়া হলঃ
১। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার
২। টিউশন ফি-এর পেমেন্ট কপি বা স্কলারশিপের ডকুমেন্ট
৩। ব্যাংক সলভেন্সি পেপার
৪। পাসপোর্টের কপি
৫। স্টাডি পারমিটের পূরণকৃত এপ্লিকেশন ফর্ম (ফ্যামিলি ডিটেল সহ)
৬। ভিসা ফি
প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য এম্বেসী ওয়েবসাইট ভিসিট করুণ। মনে রাখবেন, খুটিনাটি বিষয়ের জন্য ভিসা রিজেক্ট হয়ে থাকে।
সকল কাগজপত্র জমা দিয়ে ইন্টারভিউ দিলে পেয়ে যাবেন সেই কাঙ্ক্ষিত ভিসা।
লিঙ্কঃ
http://www.swedenabroad.com/en-GB/Embassies/Dhaka
http://www.migrationsverket.se/English/Private-individuals/Moving-to-someone-in-Sweden.html
স্পাউস ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া
আপনি চাইলে পুরো পরিবার অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী- সন্তানাদিসহ সুইডেনে যেতে পারবেন। আর তাই সুইডেন শিক্ষার্থীদের কাছে এত জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে আপনাকে ব্যাংক সলভেন্সির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
নিচে একটা রাফ এস্টিমেট দেওয়া হলঃ
১। নিজের জন্য ব্যয়ঃ ১০ x ৮,১৯০ ক্রোনা / প্রতিবছর
২। স্পাউসের জন্য ব্যয়ঃ ১২ x ৩,৫০০ ক্রোনা / প্রতিবছর
৩। বাচ্চার জন্য ব্যয় (প্রতি জন): ১২ x ২১০০ ক্রোনা / প্রতিবছর
যোগ করার পর প্রাপ্ত অর্থ আপনার ব্যাংকে দেখাতে হবে। আশার কথা হল। স্ত্রী বা স্বামী একই সাথে জব করতে পারবেন। এরজন্য আপনার আলাদা কোন ভিসার দরকার হবে না।
ওয়ার্ক পারমিট এবং পার্ট টাইম জব
সুইডেনে পার্ট টাইম জবের কোন ধরা বাধা নিয়ম নেই। শিক্ষার্থীরা নিজের ইচ্ছা মত পার্ট টাইম জব করতে পারবে। এখানে বড় শহরগুলোতে খুব সহজেই পার্ট টাইম জব পাওয়া যায়। তবে ছোট শহরগুলতে সুযোগ একটু কম।
সুইডেনে ৩০ ক্রেডিট শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা ফুল টাইম কাজ করতে পারবেন। কাজ পাওয়ার পর আপনি ওয়ার্ক পারমিট প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে হবে। ফুল টাইম জবের সময় সীমা সাধারণত ৮-১০ ঘন্টা হয়ে থাকে। সুইডিশ ভাষা জানা না থাকলে কাজ পাওয়া একটু কঠিন হয়ে যায়। তাই, আমার অনুরোধ, সুইডেনে যাবার আগে অবশ্যই সুইডিশ ভাষার কোর্স করে যাবেন।
কোর্স শেষে চাকুরীর সুযোগ ও পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির সুযোগ
পড়াশুনা শেষে আপনি ৬ মাসের জন্য জব সার্চ ভিসা এপ্লাই করতে পারবেন। ওয়ার্ক পারমিটে আবেদনের পর আপনি পেয়ে যাবেন ২ বছরের রেসিডেন্স পারমিট ও পরে আবার ২ বছর এই পারমিট বাড়িয়ে নিতে পারবেন।
এই ৪ বছর পর আপনি পার্মানেন্ট রেসিডেন্সীর জন্য আবেদন করতে পারবেন।সুতরাং, আপনার যদি গন্তব্য হয় সুইডেন তাহলে আজই নেমে পড়ুন প্রস্তুতি নিতে।
তথ্যসুত্রঃ
১। https://www.bangladeshistudentscommunity.eu/archives/258
২। https://www.bangladeshistudentscommunity.eu/archives/147
৩। http://www.amiopari.com/18208/
৪। http://sopnoghuri.com/blog/sweden-higher-studies-from-bangladesh
৫। https://campuslive24.com/scholarship/24668/সুইডেন-বিশ্ববিদ্যালয়ে-স্কলারশিপ-নিয়ে-উচ্চশিক্ষার-সুযোগ
লেখক/লেখিকা পরিচিতিঃ
সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল সমুহঃ
- স্টাইপেন্ডিয়াম হাঙ্গেরিকাম স্কলারশিপ - হাঙ্গেরিতে… হাঙ্গেরি ইউরোপের একটি অন্যতম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এটি মধ্যে ইউরোপের…
- ব্রেক্সিট–পরবর্তী নতুন নিয়মে যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসা ব্রেক্সিট–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাজ্যের সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার…
- রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ,নিজের আবেদন ইউরোপ-আমেরিকার ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের জন্য হয়ে ওঠে…
- আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ, নিজের আবেদন নিজেই করুণ নিজের আবেদনের আজকের পর্ব সাজানো হয়েছে বিশ্বের অন্যতম…