জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীনে যাওয়া উচিত- এই প্রবাদ আমরা সবাই জানি। এই প্রবাদ শুনে সবাই বুঝতেই পারছেন পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ দেশ চীন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় বেশ এগিয়ে, সেই অতীত থেকেই। পাহাড়, পর্বত, নদী, সমউদ্র, তৃণভূমি, মরুভূমি- কি নেই এই বৃহদাকার দেশের থলের মধ্যে। মহা প্রাচীরের দেশ চীনে, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পাড়ি জমাই প্রাচ্যের এই দেশে। হিসাব অনুযায়ী দেখা গেছে, এক ২০১৬ সালেই তাবদ দুনিয়া থেকে ৪,৪০,০০০ শিক্ষার্থী পড়তে এসেছে চীনে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেশ সুনাল অর্জন করেছে এবং চীন সরকারের উদার নীতির কারণে এ দেশে দিনে দিনে অন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
কেন চীনে পড়তে যাবেন?
“পিপলস রিপাবলিক অব চায়না” – আয়তন ও জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের বৃহত্তম দেশটির রাজধানী বেইজিং, ভাষা মান্দারিন আর মুদ্রা ইউয়েন। উৎপাদন, শিল্প, কৃষি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই যেন এক নম্বর এই দেশ। আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, খেলাধূলা ও গবেষণা থেকে শুরু করে কি নেই এই সব সম্ভবের দেশে। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে চীন উৎকর্ষতার শিখরে- ফলে এই দেশে পড়াশুনা করলে বিশ্বের প্রযুক্তি বিষয়ে নিজের দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হবে। কিন্তু, চীনের চাকুরির বাজার ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে- আবার, অপর দিকে, এই দেশে ব্যবসা করার পথ দিন দিন আরো খুলে যাচ্ছে। তাই অবারিত দ্বার এই দেশে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য হয়ত আপনারও দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হবে।
Image Source: pixabay.com
চীনে পড়তে যাবার জন্য নূন্যতম যোগ্যতা
ইউরোপ বা আমেরিকার মত চীনে পড়াশুনা করতে GRE/ GMAT/ SAT/ ACT কিম্বা নিদেন পক্ষে IELTS/ TOEFL জাতীয় কোন পরীক্ষায় বসতে হবে না।
চীনে যেহেতু পাশ মার্ক ৬০%। তাই আপনার একাডেমিক পরীক্ষায় ৬০% এর অধিক মার্ক থাকলে আপনি চীনে যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন। তবে আপনি ৮০% মার্ক পেলে স্কলারশিপ পেতে আপনার সুবিধা হবে। আর ডিপ্লোমা কোর্সে আবেদন করতে আপনার থাকতে হবে HSC- তে ৪.৪৩ পয়েন্ট। ব্যাচেলরে আবেদন করতে আপনাকে SSC ও HSC তে আপনার সব মিলিয়ে থাকতে হবে ৮.০ পয়েন্ট। মাস্টার্সে আবেদন করতে থাকতে হবে ৩.২০ আর পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করতে হবে ৩.৪০ পয়েন্ট সাথে থাকতে হবে পাবলিশড রিসার্চ পেপার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা ফি বছর পরিবর্তন হয়। তাই দেখে নিন, বুঝে নিন – বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদতে কি চাচ্ছে।
কোর্স সার্চ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন
চীন বছরে দুইটি সেমিস্টারের মাধ্যমে অফার করে বিভিন্ন ধরণের কোর্স। আপনি গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা, মাস্টার্স, সিনিয়র স্কলার, জেনারেল স্কলার অথবা পিএইচডি সহ যে কোন প্রোগ্রামে যেতে পারেন ।
চীনে অবস্থিত বিশ্বমানের প্রায় ১১০০ এর অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন কোর্স অফার করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সব বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ দেয় না। আবার অনেক নামী- দামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। তাই আবেদনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্ধে একটু জেনে নিতে হবে। আর এই দেশে প্রকৌশল, কৃষি, মেডিকেল ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, বিজনেস ও ম্যানেজমেন্টসহ অনেক ধরণের বিষয়ে পড়ানো হয়। তবে, প্রকৌশল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় চীনে উন্নত শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে চীনে মেডিকেল ও স্বাস্থ্যবিষয়ে পড়াশোনার জন্য বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। চীনের যেকোন রেজিস্টার্ড মেডিকেল স্কুল থেকে পড়াশুন শেষ করে এসে আপনি বাংলাদেশে প্রকটিস করতে পারবেন। শুধু আপনাকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে সম্মতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে।
চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন বেশ উন্নত ও তারা বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত শিক্ষা প্রদান করে আসছে। নিম্নে চীনের কিছু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দেওয়া হলঃ
১। Tsinghua University
২। Peking University
৩। University of Science and Technology of China
৪। Zhejiang University
৫। Fudan University
Image Source: Internet
চাইনিজ ইউনিভার্সিটির র্যাংকিং নিয়ে আরও ভালো ভাবে জানতে চাইলে তুমি এই লিঙ্কটিতে ঘুরে আসতে পারো। আশা করি র্যাংকিং নিয়ে তোমার আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
চাইনিজ কিংবা ইংলিশ দুই ভাষাতেই পড়তে পারবেন । ডিপ্লোমাতে সারাধরণ চাইনিজে পড়ানো হয়। ইংলিশ কোর্স খুব একটা পাওয়া যায়না। অনার্স , মাস্টার্স, পিএইচডি চাইনিজ কিংবা ইংলিশে করতে পারেন । বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটি এখন IELTS চাচ্ছে। সর্বনিম্ন ৬.০ ব্যান্ড। তবে, আপনার প্রোফাইল সমৃদ্ধ হলে সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও IELTS ছাড়াই আবেদন গ্রহণ করছে। চীনা ভাষায় দক্ষতা প্রমাণের জন্য HSK 4 পরীক্ষার স্কোর প্রয়োজন পড়ে আর যদি খোদ চাইনিজ ভাষায় পড়তে চান তাহলে প্রয়োজন পড়বে HSK 5 । তবে, এই স্কোরও বাধ্যতামূলক নয়। চীনে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপনাকে দিয়ে এই সংক্রান্ত কোর্স করিয়ে নেবে। তাই, এই বিষয়েও কোন চিন্তা নেই।
ডকুমেন্টস সত্যায়ন
চীনে আবেদনের জন্য সকল ডকুমেন্টস নোটারাইজড করে দিতে হবে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় আবার আপনার সার্টিফিকেট চাইনীজ ভাষা/ মান্দারিন ভাষায় চেয়ে থাকে। তাদের জন্য আপনাকে অনুবাদক দিয়ে আপনার ডকুমেন্টস অনুবাদ করিয়ে নিতে হবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন ইংরেজীতে প্রদত্ত সকল সার্টিফিকেট এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময়সীমা ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
আগেই বলেছি চীনে দুইটি সেমিস্টার পড়ানো হয় প্রতি বছরঃ যার একটি মার্চে শুরু হয় আর অপরটি সেপ্টেম্বরে শুরু হয়।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা বেশ কষ্টকর- তাই, আবেদন করার জন্য যদি চীনে অবস্থিত কোন পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়ের সাহয্য নেন তাহলে অনেকটাই সুবিধা হবে। যেহেতু, আবেদন করতে টাকা-পয়সা খরচ হবে, তাই বিশ্বস্ত না হলে এই বিষয়ে না এগোনোই ভালো।
Image Source: Internet
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য যেসকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দরকার পরবে তার তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ
১। সকলএকাডেমিক সার্টফিকেট এবং মার্কশীট (অবশ্যই নোটারাইজড)
২। Study Plan ও ২ টি রিকমেন্ডেশন লেটার (সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকের কাছ থেকে নিতে হবে)
৩। পাসপোর্টের কপি ও সাদা ব্যাক-গ্রাউন্ডের ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি (নোটারাইজড)
৪। স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট
৫। জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র, বায়ো-ডাটা
পড়াশোনার খরচ ( টিউশন ফি) ও স্কলারশিপ
সাধারণত চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনা করতে বছরে খরচ হবে ২-৩ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে এই ফি-এর তারতম্য হয়। আর মেডিকেল বিষয়ে পড়তে খরচ হবে ৩-৬ লাখ টাকা। চীনে মেডিকেল কোর্স ৫ বছরের আর সাথে ১ বছরের ইন্টার্নশীপ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে চীনা সরকার প্রচুর পরিমাণে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে, যেগুলো আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেভেলে টিউশন ফি’র জন্য ফুল ও পার্শিয়াল ফান্ডিংয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এর মাঝে রয়েছে-
১। Chinese Government Scholarship
২। University/ Presidential Scholarship
৩। Confucius Institute Scholarship
৪। Local Government Scholarship / Provincial Scholarship
৫। Enterprise Scholarship
তাই, যোগ্যতা থাকলে এই দেশে স্কলারশিপের সুযোগ অনেক বেশি।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া ও ডকুমেন্টস চেকলিস্ট
চীনের বিশ্ববিদ্যালয় আপনার আবেদন গ্রহণ করলে তারা আপনাকে প্রদান করবে JW202 (চীনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সীলযুক্ত) । আর এই JW 202 ভিসা আবেদনের জন্য একান্ত প্রয়োজন। সকল ডকুমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত চীন এম্বেসীতে করতে হবে ভিসার জন্য আবেদন।
ভিসা আবেদন করার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের লিস্ট নীচে তুলে ধরা হলঃ
১। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো Admission Letter এবং JW 202
২। সকল নোটারাইজড ডকুমেন্টস, মার্কশিট ও সকল সনদ
৩। পাসপোর্ট ও ফটোগ্রাফ
৪। রিকমেন্ডেশন বা রেফারেন্স লেটার
৫। ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও আর্থিক স্বচ্ছলতার ডকুমেন্টস
৬। মেডিকেল রিপোর্ট
৭। IELTS এর সনদ (যদি থাকে)
৮।স্কলারশিপের পেপার (যদি থাকে)
Image Source: Internet
চীনের আবাসন ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার ব্যয়
চীনে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে হোস্টেল। হোস্টেলে থাকতে আপনাকে দিতে হবে ভার্সিটিভেদে বাৎসরিক ৩০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা।
সকল দেশের মত এই দেশেও খরচ নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের মত। তবে নিজে রান্না করে খেলে আপনি প্রভিন্সভেদে মাসিক ৪০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকায় সেরে নিতে পারবেন। আর যদি বাইরে খান তাহলে এই খরচ মাসিক ২৫,০০০ টাকার মত লেগে যাবে।
চীনের যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন বেশ ভালো, তেমনই বেশ সাশ্রয়ী। এখন চলুন বিভিন্ন যানবাহনে খরচ কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক:
মেট্রো: ৪০ টাকা (প্রায়)
ট্যাক্সি/কি.মি: ৩০ টাকা (প্রায়)
সিটি বাস: ২৫ টাকা (প্রায়)
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে স্টুডেন্ট পাস থাকলে মাসে তাতে খরচ হবে মাত্র ১৩০০ টাকা
পার্ট টাইম জব ও স্থায়ী বসবাস এর সুযোগ
চীনে পড়াশুনার পাশাপাশি জব করা সকল প্রদেশে বৈধ নয়। তাই, আপনি জব করতে পারবেন কি না সেটা আপনার বিশ্ববিদ্যালয় যে প্রদেশে সেটার উপর নির্ভর করবে। আর চীনে চাকুরীর বাজারে বিদেশী হিসেবে চাকুরী পাওয়া কঠিন। তাই, আপনি স্থায়ী বসবাসের কথা ভাবলে এই দেশ খুব একটা ভালো ডেস্টিনেশন হবে না। কিন্তু, জ্ঞান অর্জনের জন্য এই দেশ সমৃদ্ধ।
Image Source: Internet
আপনারা চীনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেক কিছুই জেনে গেলেন। বাকিটা আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘেটে জানতে হবে। তাহলে আর দেরী কেন? এখনি করুন- নিজেই নিজের আবেদন।
সতর্কবানীউপরোক্ত আর্টিকেল এর সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রীহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া এবং এম্বেসী এর ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। হালনাগাদ তথ্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং এম্বেসী এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এ নজর রাখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। উপরোক্ত আর্টিকেল এর কোন তথ্য/উপাত্ত আপনার কাছে ভুল মনে হলে সঠিক তথ্যের রেফারেন্স/ওয়েবলিংক সহ নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ধন্যবাদ
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these cookies, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may have an effect on your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. This category only includes cookies that ensures basic functionalities and security features of the website. These cookies do not store any personal information.
Any cookies that may not be particularly necessary for the website to function and is used specifically to collect user personal data via analytics, ads, other embedded contents are termed as non-necessary cookies. It is mandatory to procure user consent prior to running these cookies on your website.