প্যারিসের ঘুরতে, দেখতে যাবার অথবা আইফেল টাওয়ারের সামনে বসে কফিতে চুমুক দেবার স্বপ্ন দেখেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া আসলেই মুসকিল। হ্যাঁ, আজ কথা বলছি ফ্রান্সের। পশ্চিম ইউরোপের সেনজেনভুক্ত দেশ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস আর মুদ্রা ফ্র্যাঙ্ক, তবে এ দেশে ইউরো প্রচলিত। আর্ট, শিল্প সাহিত্যের আঁতুড় ঘর ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আপনি সাহিত্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৌশলসহ নানা বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারবেন। আর সেই পথ বাৎলে দিতে আমাদের আজকের আয়োজন। তাই, দেরী না করে এক বসায় পড়ে ফেলুন আজকের পর্ব।
ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার মাধ্যম
ফ্রানের আন্তর্জানিক মানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে আপনি লিটারেচার, হিস্ট্রি, ল’, স্যোশাল সাইন্স, বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, ফিজিক্স, ম্যাথেমাটিকস, ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্যুরিজম, ডিজাইন ক্রাফট, থিয়েটার ও ফিল্ম, ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক, স্কাপচার, ড্রয়িং, পেইন্টিং, ফ্যাশন ডিজাইনিং, ব্যালেট ড্যান্স সহ নানাবিধ বিষয়ে অর্জন করতে পারবেন জ্ঞান।
বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানোর মাধ্যম ফ্রেঞ্চ। তাই, এদেশে পড়তে চাইলে আপনাকে অব্যশই জানতে হবে ফেঞ্চ ভাষা। তবে, শুধু ফেঞ্চ নয়, অল্প পরিসরে হলেও ইংরেজীতেও এদেশে কোর্স অফার করা হয়ে থাকে। তাই আবেদনের সময় খেয়াল করবেন কোন ভাষায় পাঠদান করা হয়ে থাকে।
নিচে ফ্রান্সের কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দেওয়া হল। গুগল সার্চেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি নক্ষত্র জানতে পারবেন।
- Université Paris 6 Pierre and Marie Curie
- Université Paris Sud (Paris XI)
- École Normale Supérieure Paris
- Université Claude Bernard Lyon 1
- Université de Bordeaux
- Université Denis Diderot Paris 7
- Université de Strasbourg
ফ্রান্সে অধ্যয়নের যোগ্যতা
আপনি ফ্রান্সে ব্যাচেলর, মাস্টার্স অথবা পিএইচডি- যে কোন প্রোগ্রামের জন্য পাড়ি জমাতে পারবেন। ব্যাচেলর প্রোগ্রামের জন্য অবশ্যই এইচ,এস,সি আর মাস্টার্সের জন্য ব্যাচেলর এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য অবশ্যই আপনার মাস্টার্স ডিগ্রী থাকতে হবে।
আপনার কোর্স যদি ফ্রেঞ্চ ভাষায় হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতার প্রমাণপত্র দিতে হবে। আর এজন্য আপনার যোগাযোগ করতে হবে Alliance Francaise আর করে ফেলতে হবে ফ্রেঞ্চ ভাষার উপর কোর্স। আপনাদের সহায়তার জন্য Alliance Francaise de Dhaka এর লিঙ্কটি হলঃ (https://www.afdhaka.org/)।
ইংরেজী ভাষার কোর্সের জন্য আপনাকে IELTS/ TOEFL পরীক্ষার সনদ দিতে হবে। ব্যাচেলরে আবদনের জন্য ন্যূনতম ৫.৫ চাওয়া হলেও ৬.০ থাকলে আপনার আবেদন গৃহীত হবার সম্ভবনা থাকে। আর মাস্টার্স প্রোগ্রামে আবেদন করতে ৬.০ প্রয়োজন পড়বে আর ৬.৫ থাকলে আপনার ভিসা ও অন্যান্য সুবিধা পেতে সুবিধা হবে। আর TOEFL দিয়ে আবেদন করতে আপনাকে ব্যাচেলরে আবেদনের জন্য ৫৫০ আর মাস্টার্সের জন্য ৬০০ স্কোর অর্জন করতে হবে। তবে আপনার স্কোর বেশি থাকলে ভিসা আবেদনে আপনি এগিয়ে থাকবেন।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়, অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপনার ইংরেজী পারদর্শিতা যাচাই করার জন্য অনলাইন টেস্ট বা স্কাইপিতে ইন্টারভিয় নিয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া
ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদনের সময়সীমা নির্ধারিত থাকে। এখানে বছরে তিনটি সেমিস্টার পড়ানো হয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সমূহঃ
১। আবেদন পত্র
২। সকল মূল সনদ ও মার্কশীট এর কপি
৩। জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ ও পাসপোর্ট- এর কপি
৪। IELTS/ TOEFL / French Language সনদ
৫। মোটিভেশন লেটার/ রেফারেন্স লেটার/ সিভি [প্রযোজ্য ক্ষেত্রে]
এই সকল ডকুমেন্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল। তাই, আবেদনের পূর্বে অবশ্যই সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে নিতে ভুলবেন না।
টিউশন ফি
২০১৯ সালের তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী, ফ্রান্সের লাইসেন্সড বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর কোর্সে পড়তে আনুমানিক ২৭৭০ ইউরো/ প্রতি বছর আবার, মাস্টার্স কোর্সে পড়তে প্রয়োজন পড়বে ৩৭৭০ ইউরো / প্রতি বছর। ডক্টোরাল কোর্সের জন্য লাগবে ৩৮০ ইউরো/ প্রতি বছর। তবে এই হিসাব নিকাষ বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
আপনার আবেদন গৃহীত হলে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত টিউশন ফি প্রদান করতে হবে।
স্কলারশিপ বৃত্তান্তঃ
ফ্রান্সে সরকারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন স্কলারশিপের সুযোগ রয়েছে। এসব স্কলারশিপে আংশিক বা পুরো টিউশন ফি মওকুফ হতে পারে। কিছু কিছু স্কলারশিপে মাসিক ভাতাও প্রদান করা হয়ে থাকে।
এসব স্কলারশিপ খুঁজতে আবেদন করতে হবে নিচের লিঙ্কের মাধ্যমেঃ
ব্যাংক সলভেন্সি
ফ্রান্সে ভিসার ক্ষেত্রে ব্যাংকে আপনাকে ১০ থেকে ১৫ হাজার ইউরো দেখাতে হবে। যে ব্যক্তি আপনাকে ব্যাংক স্পন্সরশিপ বহন করবেন, সে যদি প্রথম রক্তের সম্পর্কের অভিভাবক হন, তাহলে ভিসার ক্ষেত্রে আপনি সুবিধা পাবেন। এছাড়া অন্য যে কোন অভিভাবক আপনাকে স্পন্সর করতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনাকে সঠিক কাগজপত্র ও প্রমাণাদি এম্বাসীতে জমা করতে হবে। আপনি চাইলে নিজের নামেও ব্যাংকে টাকা দেখাতে পারেন। ভিসা পাবার পর আপনি চাইলে এই টাকা যেকোন সময় তুলে নিতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, ফ্রান্সে প্রবেশকালে ইমিগ্রেশনে আপনাকে ব্যাংক সলভেন্সি পেপার দেখানোর জন্য অনুরোধ করতে পারে। সুতরাং, যাত্রার সময় সলভেন্সি পেপার আপনার সাথেই রাখবেন।
ভিসা আবেদন পর্ব
ভিসার জন্য প্রথমে এম্বাসীতে ই-মেইল করে এপন্টমেন্ট নিতে হবে। সকল কাগজপত্র সহকারে এম্বাসীতে উপস্থিত হলে ওই দিনই দ্বিতীয়বারের জন্য আরেকটি এপন্টমেন্ট দেওয়া হবে। ভিসার সকল কাগজপত্র জমা দেবার পর আপনাকে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে ভিসা পাবার জন্য।
সাধারণত যে সকল কাগজপত্র ভিসার জন্য জমা করতে হবে তা নিচে দেওয়া হল। তবে এম্বেসীতে যোগাযোগ করে আপনাকে অবশ্যই চেকলিস্টটা আরেক বার দেখে নিতে হবে, কারণ এম্বেসী অনেক সময় তাদের চেকলিস্ট পরিবর্তন করে থাকে।
১। পাসপোর্ট (অবশ্যই ৬ মাসের অধিক মেয়াদ থাকতে হবে)
২। অ্যাপ্লিকেশান ফর্ম ও পাসপোর্ট সাইজের ২ কপি
( অ্যাপ্লিকেশান ফর্ম ডাউনলোড করুন এখান থেকেঃ https://bd.ambafrance.org/Download-the-application-form-for )
৩। ফ্লাইট বুকিং টিকেট (এটা করতে কোন টাকা লাগে না, শুধু বুকিং দিবেন)
৪। ভিসা অ্যাপ্লিকেশান ফি বা স্কলারশিপ লেটার (যদি পেয়ে থাকেন)
(স্কলারশিপ প্রাপ্তদের ফি লাগে না)
৫। হেলথ ইস্যুরেন্স (যতদিন এর কোর্স ততদিনের করতে হবে)
৬। জন্ম নিবন্ধন
৭। সিভি/রিজিউমি
৮। সকল একাডেমিক ডকুমেন্টস
৯। ইউনিভার্সিটির অফার লেটার
১০। ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সল্ভেন্সি (যিনি আপনার সকল খরচ বহন করবেন তার অর্থাৎ স্পন্সরের)
১১। হাউজিং সার্টিফিকেট/ ডকুমেন্ট (যদি ফ্রান্সে কোন আত্মীয়ের বাসাকে হাউজিং এর জন্য দেন তাহলে ঐ শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সত্যায়িত উনার/উনাদের বাসার সকল কন্ট্রাক্ট পেপার দেখাতে হবে)
১২। স্পন্সরের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট কপি, যা দ্বারা আপনার সাথে উনার সম্পর্ক কি টিউশন ফি পরিশোধের কপি/প্রমাণ
১৩। IELTS/ TOEFL/ফ্রেঞ্চ ভাষা দক্ষতার সার্টিফিকেট (Alliance Française Certificates)
১৪। ট্রেনিং সার্টিফিকেট (যদি লাগে)
১৫। কাজের অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট (যদি লাগে)
আবাসন ও জীবনযাত্রার ব্যয়
ফ্রান্সে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব হোস্টেল রয়েছে। আপনি চাইলে পেইং গেস্ট অথবা শেয়ারিং এপার্টমেন্ট থাকতে পারবেন। এদেশে থাকা খাওয়ার জন্য আপনাকে মাসে খরচ করতে হবে ৪০০-৬০০ ইউরো। তবে এই খরচ পুরোটাই আপনার উপর নির্ভর করে। মেডিকেল ইনস্যুরেন্স বাবদ আপনার খরচ করতে হবে ৪২ ইউরো/ প্রতি জন/ প্রতি মাস।
পার্ট টাইম জব
ফ্রান্সে বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে আপনি সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পাবেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ফ্রেঞ্চ সরকার বিদেশী নাগরিকদের বছরে ৯৬৪ ঘন্টা কাজ করার অনুমতি প্রদান করে।
ফ্রান্সে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ
পড়াশুনা শেষ করার পর আপনি ফান্সে ১ বছর জব খোঁজার জন্য সময় পাবেন। আর আপনি যদি হয়ে থাকেন তরুণ গবেষক, কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বা ইনোভেটিভ ইকোনমিক প্রোজেক্টের ডিজাইনার, ফ্রেঞ্চ টেক প্রোগ্রামের অংশ গ্রহণকারী, আর্টিস্ট, উচ্চ পর্যায়ের অ্যাথলেট তাহলে আপনার জন্য ইস্যু করা হবে Plurennial Residence Card (“Passeport Talent”) – এই কার্ডটির আওতায় আপনি ও আপনার পরিবারকে ৪ বছরের ভিসা দেওয়া হবে, আর এই সময়ে আপনি চাকুরী করতে পারবেন।
ফান্সে একটানা ৫ বছর বৈধভাবে থাকার পর শর্ত সাপেক্ষে স্থায়ী বসবাসের (পিআর) জন্যে আবেদন করতে পারবেন। সব শর্ত রক্ষিত হলে পেয়ে যাবেন ফ্রান্সের নাগরিকত্ব।
ফ্রান্স একাধারে আধুনিক কিন্তু সম্ভ্রান্ত ও প্রাচীন। ফ্রান্স ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী বা সাহিত্যিকদের জন্য যেন কাঙ্ক্ষিত ও আরাধ্য স্থান। তাই, বসবাস ও পড়াশুনার জন্য ফ্রান্স এত বেশি লোভনীয়।
তথ্যসুত্র
লেখক/লেখিকা পরিচিতিঃ
সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল সমুহঃ
- স্টাইপেন্ডিয়াম হাঙ্গেরিকাম স্কলারশিপ - হাঙ্গেরিতে… হাঙ্গেরি ইউরোপের একটি অন্যতম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এটি মধ্যে ইউরোপের…
- ব্রেক্সিট–পরবর্তী নতুন নিয়মে যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসা ব্রেক্সিট–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাজ্যের সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার…
- রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ,নিজের আবেদন ইউরোপ-আমেরিকার ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের জন্য হয়ে ওঠে…
- আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ, নিজের আবেদন নিজেই করুণ নিজের আবেদনের আজকের পর্ব সাজানো হয়েছে বিশ্বের অন্যতম…