লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ নিজের আবেদন

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সেঞ্জেনভুক্ত দেশের লিস্টে অন্যতম এক নাম লিথুয়ানিয়া। শুধু এর সৌন্দর্য্য বিশ্ববাসীকে এর দিকে আকৃষ্ট করে না বরং এর সাথে উচ্চমানের শিক্ষার ব্যবস্থ এই দেশকে সুপরিচিত করে তুলেছে বিশ্ববাসীর কাছে। তবে আর দেরি কেন? চলুন আজ লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষার সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টপাত করি।

কেন লিথুয়ানিয়ায় পড়তে যাবেন?

বাল্টিক সাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দেশ- যা ঠিক সুইডেনের বিপরীতে অবস্থিত তার নাম লিথুয়ানিয়া। এই দেশের আয়তন ৬৫,৩০০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা ২.৭৯৪ মিলিয়ন। এই দেশের জিডিপি পার ক্যাপিটা ১,৯১৫৩.৪১ ইউএসডি। লিথুয়ানিয়ার সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী হল ভিলনিয়াস। অফিসিয়াল ভাষা লিথুয়ানিয়ান এবং মুদ্রা ইউরো। এর প্রতিবেশি দেশগুলো হল লাটভিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়া।

Study in Lithuania
Image Source: pixabay.com

কোর্স সার্চ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে দিন দিন লিথুয়ানিয়া বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে। যদিও সে বছর খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী গেলেও বর্তমানে কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে। যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। লিথুয়ানিয়ায় বিশ্বমানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই যেখানে ব্যাচেলর পড়ানো হয় তাদের নিজ অফিসিয়াল ভাষায় সেখানে লিথুয়ানিয়ায় সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে ইংরেজীতে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি করার সুযোগ। এখানে আপনি মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইন্সসহ বিভিন্ন ধরণের কোর্স করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য আপনাকে কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলো ঘেটে দেখতে হবে।

কোর্স খুঁজতে সাহায্য নিতে পারেন এই ওয়েবসাইট এরঃ https://studyin.lt/study-programmes/

আপনাদের সুবিধার্থে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিচে দেওয়া হলঃ

  • Aleksandras Stulginskis University
  • Kaunas University of Technology
  • Vytautas Magnus University
  • Vilnius University
  • Klaipėda University
  • Vilnius Gediminas Technical University
  • Vilnius Academy of Fine Arts
  • Šiauliai University
  • Mykolas Romeris University
  • Lithuanian University of Health Sciences
  • Lithuanian University of Educational Sciences
  • Kaunas University of Technology

লিথুয়ানিয়ায় পড়তে যাবার জন্য নূন্যতম যোগ্যতা

এদেশে ব্যাচেলর পড়তে HSC, মাস্টার্স করতে ব্যাচেলর আর পিএইচডি করতে প্রয়োজন পড়বে মাস্টার্স ডিগ্রীর। IELTS ছাড়া এদেশে যাওয়া গেলেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে IELTS-এ স্কোর থাকতে হবে ৬.০।

University in Lithuania
Image Source: Internet

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়সীমা/ সেশন

অন্যান্য সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মতো এখানেও বছরে ২টি সেশনে ভর্তি প্রক্রিয়া চলে। প্রতিবছর- সেপ্টেম্বর ও জানুয়ারি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেপ্টেম্বর এ বেশি সাবজেক্টে ভর্তির সুযোগ থাকে।

ডকুমেন্টস সত্যায়ন

লিথুয়ানিয়ায় পড়াশুনা করতে অবশ্যই আপনাকে ডকুমেন্টস সত্যায়িত করতে হবে।

     (১) প্রথমে সকল সার্টিফিকেট ও মার্কশীট শিক্ষা বোর্ড থেকে সত্যায়িত করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে ৩-৫ দিন সময় লাগবে। এই সময়ে ৩/৪ সেট সাথে রাখবেন। এখানে ফি বাবদ ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হবে।

     (২) এরপর যেতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এখানেও ৩/৪ কপি ডকুমেন্টস নিয়ে যাবেন। এখানে কাগজ-পত্র সকাল ১১ টা থেকে জমা পড়া শুরু হয় আর বিশেষ কোন সমস্যা না থাকলে ঐ দিন বেলা ৩টা বা ৪টার মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবেন।

     (৩) এরপর পাসপোর্টের ফটোকপি নোটারাইজড ৩ কপি আইন মন্ত্রণালয় থেকে সত্যায়ন করতে হবে। এজন্য সময় লেগে যাবে সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ৪টা পর্যন্ত।

     (৪) এই সকল কাগজপত্র আপনাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে সত্যায়নের জন্য। আর এইগুলো সত্যায়ন করতে সময় লাগবে ২ দিন। কাগজ জমা নেওয়া শুরু হয় সকাল ১১ টায় আর ফেরৎ দেওয়া হয় বেলা ৩ টায়। তবে মনে রাখবেন, অনেক শিক্ষার্থী এই কাজের জন্য লাইনে দাঁড়ায়- তাই সকাল সকাল এসে লাইনে দাড়ানোই ভালো।  

ভর্তি আবেদন প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

প্রথমে আপনাকে আবেদনের জন্য সকল কাগজপত্র ডাক যোগে বা অনলাইনে পাঠাতে হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে, তারা আপনাকে ৫-৭ দিনের মধ্যে অফার লেটার পাঠাবে। আর এরপর আপনাকে ১ বছরের টিউশন ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত একাউন্টে জমা করতে হবে। চিন্তা করার কোন কারণ নেই- ভিসা না পেলে আপনি অবশ্যই এই টাকা ফেরৎ পাবেন। তবে এখানে এপ্লিকেশন ফি ১০০-২০০ ইউরো প্রদান করতে হবে, যা অফেরৎযোগ্য। এরপর টিউশন ফি জমা দেওয়ার পর তারা আপনাকে ৩/৪ দিনের মধ্যে অফার লেটার এবং ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টস পাঠাবে। 

লিথুয়ানিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সকল কাগজপত্র লিথুয়ানিয়ার সেন্টার ফর কোয়ালিটি এসেসমেন্ট ইন হাইয়ার এডুকেশন (SKVC) থেকে রেকগনাইজ করাতে হবে। পূর্বে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পূর্বেই করা হত কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে প্রথমে আপনাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করতে হবে এবং সেখান থেকে পাওয়া কনডিশনাল অফার লেটার প্রুফ অফ পারপাস হিসেবে জমা দিতে হবে। এরপরই আপনি ডকুমেন্টস রিকগনাইজ করানোর সু্যোগ পাবেন। আপনি সকল ডকুমেন্টস রিকগনাইজের জন্য নিজ দেশ থেকে পাঠাতে পারেন। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালে তারা তাদের অফিশিয়াল ই-মেইল থেকে সকল ডকুমেন্টস SKVC-এ পাঠিয়ে দিবে। SKVC-এ এপ্লিকেশন ফর্মের লিঙ্ক ও সকল কাগজপত্র পাঠাবার ঠিকানা নিচে দেওয়া হলঃ

The Centre for Quality Assessment in Higher Education, SKVC

  1. Goštauto g. 12, LT-01108 Vilnius, Lithuania.

E-mail: [email protected]

Website:https://www.skvc.lt/default/en/60/apply/documentation_requirements

University in Lithuania
Image Source: Internet

SKVC তে যে সকল কাগজপত্র পাঠাতে হবেঃ

     ১। সকল মার্কশীট ও সার্টিফিকেটের ফটোকপি

     ২। পাসপোর্টের ফটোকপি

     ৩। প্রুফ অফ পারপাস

মনে রাখবেন সকল কাগজপত্র নোটারাইজড হতে হবে। SKVC-এ রিকগনাইজের জন্য কোন ফি লাগে না আর পুরো কাজটি করতে ২০-২৫ দিন সময় লাগে।

এবার আসি ভর্তির জন্য যেসকল কাগজপত্র লাগে তা নিয়েঃ

১। একাডেমিক সার্টফিকেট এবং মার্কশীট

২। IELTS এর সনদ

৩। মোটিভিশন লেটার ও রিকমেন্ডেশন লেটার

৪। CV

৫। পাসপোর্টের কপি ও ফটোগ্রাফ (৩৫/৪৫)

৬। এপ্লিকেশন ফর্ম ও এপ্লিকেশন ফর্ম জমা দেওয়ার রশিদ

৭। হাউজিং ফর্ম

অনেক ক্ষেত্রে আপনাকে অনলাইনে সাক্ষাতকার দিতে হতে পারে।  

টিউশন ফি

লিথুয়ানিয়ায় পড়াশুনার খরচ অনেক কম। বছরে সাধারণত ২৫০০ থেকে ৪৫০০ ইউরো দিতে হয় মাস্টার্স প্রোগ্রামে আর ব্যাচেলরে দিতে হয় ১৩০০-৪৫০০ ইউরো।

আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ

লিথুয়ানিয়ায় পড়াশুনা করতে চাইলে ব্যাংকে ৬-৭ লক্ষ টাকা জমা দেখাতে হবে। যে স্পন্সর করবেন তার আয়ের উৎস দেখাতে হবে আর ব্যবসায়ী হলে ট্রেডিং লাইসেন্স দেখাতে হবে।

Students in Lithuania
Image Source: Internet

ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া ও ডকুমেন্টস চেকলিস্ট

লিথুয়ানিয়ার এম্বেসী বাংলাদেশে না থাকায় অবশ্যই আপনাকে ভারতের দিল্লীতে যেতে হবে। এজন্য আপনাকে আগে ভাগেই নিতে হবে এপয়েন্টমেন্ট। ভিসা আবেদন জমা নেওয়ার সময় আপনার একটি সাক্ষাতকার নেওয়া হবে আপনার ইংরেজী দক্ষতা দেখার জন্য। এই ভিসা পেতে সময় লাগে প্রায় ১৪ দিন। আপনাকে সাধারণত ১ বছর বা ৬ মাসের ভিসা প্রদান করা হবে। এবং পরবর্তীতে লিথুয়ানিয়া গিয়ে ভিসা শেষ হবার ৪ মাস আগে টেম্পোরারী রেসিডেন্স পারমিট (TRP) -এর জন্য এপ্লাই করতে হবে। এই TRP এর জন্য পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সত্যায়িত করতে হবে। TRP নেওয়ার সময় আপনাকে ব্যাংক স্টেটমেন্টও দেখাতে হবে আর এসময় আপনার একাউন্টসে কমপক্ষে ২৩০০ ইউরো ২/৩ সপ্তাহের জন্য থাকতে হবে।   

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, ভিসার জন্য আপনাকে নিম্নোক্ত কাগজপত্র জমা দিতে হবেঃ

১। এপ্লিকেশন ফর্ম

২। পাসপোর্ট ও  ফটোগ্রাফ (৩৫/৪৫)

৩। জন্ম নিবন্ধন ও NID কার্ড

৪।সকল সত্যায়িত ডকুমেন্টস, মার্কশিট ও সকল সনদ

৫। অফার লেটার ও ভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য ডকুমেন্টস

৬।অ্যাকোমোডেশন সনদ

৭। ব্যাংক সলভেন্সি পেপ্যার

৮।৩ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট

৯।পুলিশ ক্লিয়ারান্স

১০।হেলথ ইন্স্যুরেন্স

১১।IELTS স্কোরের কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)

১২। কনফর্মড অন-ওয়ে টিকিট [এটি আপনি রিজার্ভ করবেন কিন্তু খেয়াল রাখবেন যেন ইটেনারিতে যেন কনফর্মড স্ট্যাটাস থাকে]

ভিসা পাবার পর আপনি অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়কে ইমেইল করবেন। তারা আপনাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করার এবং সকল ফর্মালিটিতে হেল্প করার জন্য একজন মেন্টর নিয়োগ করবে।

ইন্ডিয়ায় অবস্থিত লিথুয়ানিয়া এম্বেসীর ঠিকানাঃ

Lithuania Embassy
Address: C-93, Anand Niketan, New Delhi, 110021, India

Phone: +91 11 4313 2200 । https://in.mfa.lt/in/en/

Life in Lithuania
Image Source: Internet

লিথুয়ানিয়ায় আবাসন ব্যবস্থা

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে হোস্টেলের ব্যবস্থা। মনে রাখবেন ভিসা পাওয়ার পর কয়েক মাসের হোস্টেলের ফি জমা করে দিতে হবে। হোস্টেলের ফি সাধারণত মাসে ৪৫-২০০ ইউরো হয়ে থাকে।

মাসিক খরচ এবং পার্ট টাইম জব এর সুযোগ

লিথুয়ানিয়ায় খুব কম খরচেই আপনি থাকতে পারবেন। ভার্সিটির হোস্টেলে জায়গা পেলে আপনি ১৫০-৩০০ ইউরো খরচের মধ্যে সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারবেন।

এই দেশে আপনি সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারবেন। কিন্তু সামার ভ্যাকেশনে আপনি ফুল টাইম কাজ করতে পারবেন। এখানে কাজ পাওয়া একটু কঠিন- যদি এদেশের ভাষা না জানা থাকে। মনে রাখবেন, এইসব কাজ করে পড়াশুনার খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব।

কোর্স শেষে চাকুরী ও স্থায়ী বসবাস এর সুযোগ

লিথুয়ানিয়ায় সফল ভাবে পড়াশুনা শেষে আপনি ৬ মাসের জব সার্চ ভিসা পাবেন। এই সময়ে জব পেয়ে গেলে আপনি ২ বছরের জন্য TRP (Temporary Resident Permit)  পাবেন। এবং এই ২ বছরের পর PR (Permanent Resident Permit) এর জন্য আবেদন করতে পারবেন। লিথুয়ানিয়ায় ১০ বছর থাকার পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়।

একটি তথ্য না বললেই নয়, লিথুয়ানিয়ায় সফল ভাবে কোর্স সম্পন্ন করার পর আপনি ইউরোপের যেকোন দেশে চাকুরী করতে পারবেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবেন।

তাহলে পাড়ি জমাতে দেরি কেন – স্বপের দেশ লিথুয়ানিয়ায়।

Life in Lithuania
Image Source: Internet

তথ্যসুত্রঃ

আর্টিকেলটি শেয়ার করতে চাইলে

লেখক/লেখিকা পরিচিতিঃ

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments