ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর ফুটবলের জাদুগরী দেখতে ভালো লাগে না এমন কথা বলা খুব কঠিন। এমনকি যারা পর্তুগালের খেলা পছন্দ করেন না, তারাও তাকে ভালোবাসেন। আপনাদের সামনে আজ নিয়ে আসবো- ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর দেশ পর্তুগাল নিয়ে। কথা হবে আজ আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী ইউরোপের দেশ পর্তুগালে উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে। পর্তুগাল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ এবং এই দেশ সেনজেন চুক্তির আওতায় রয়েছে। তাই পড়ুন, জানুন এবং দেখে নিন পর্তুগালে উচ্চশিক্ষার সার্বিক দিক।
কেন পর্তুগালে পড়তে যাবেন?
দক্ষিণ- পশ্চিম উপকূলে আটলান্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ পর্তুগালের রাজধানী লিসবন- এদেশের সবচেয়ে বড় শহর। পর্তুগালের ভাষা পর্তুগীজ ও মুদ্রা ইউরো। প্রাচীনকালে এই দেশ শক্তি ও বৃত্তিতে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। ১৬শ শতকের দিকে এই সমৃদ্ধিতে ভাটা পড়ে। এদেশের আয়তন ৯২, ২১২ বর্গ কিলমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ।
কোর্স সার্চ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন
পর্তুগালে অনেক উন্নত্মানের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এইসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা, ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি- সকল ধরণের কোর্সই করতে পারবেন। এছাড়া এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে হরেক রকমের সাবজেক্ট যেমনঃ সাইন্স, ইকোনমিকস, বাণিজ্য, আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, একাউন্টিং, মেডিকেলসহ বহু ধরণের কোর্স। কিন্তু মনে রাখবেন, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্তুগীজ ভাষায় কোর্স অফার করা হয়ে থাকে। তাই, কোর্স ও বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করার আগে দেখে নেবেন, সেখানে ইংরেজী মাধ্যমে কোর্স অফার করা হয় কি না?
পর্তুগীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা পেতে নিম্মোক্ত ওয়েবসাইট গুলোর সাহায্য নিতে পারেনঃ
https://www.study-research.pt/
অথবা
https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_universities_and_colleges_in_Portugal
নিচে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেওয়া হলঃ
- University of Lisbon
- University of Porto
- New University of Lisbon
- University of Minho
- University of Coimbra
- University of Aveiro
পর্তুগালে পড়তে যাবার জন্য নূন্যতম যোগ্যতা
পর্তুগালে পড়াশুনার জন্য অনেকেরই পছন্দ- কারণ, এদেশে পড়তে যাবার জন্য ইংরেজীতে পারদর্শিতার কোন সার্টিফিকেট দিতে হয় না। তাই যারা IELTS দিতে ভয় পাচ্ছেন, তাদের জন্য এই দেশ হবে উচ্চশিক্ষার অন্যতম ডেস্টিনেশন। কিন্তু, ইংরেজীতে কথা বলার দক্ষতা ও সার্টিফিকেট থাকলে আপনি ভিসা পাওয়ার জন্য বেশী যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। এদেশে ব্যাচেলর প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে উচ্চ মাধ্যমিক, মাস্টার্সে আবেদনের জন্য ৪ বছরের ব্যাচেলর এবং পিএইচডি পড়তে আপনাকে ২ বছরের মাস্টার্স থাকতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময়সীমা ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
এই দেশে বছরে দুইটি সেশন থাকে। প্রথমটির আবেদনকাল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি আর দ্বিতীয়টির আবেদনকাল এপ্রিল থেকে জুলাই।
প্রথমেই আপনাকে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হবে। এবং অনলাইনেই সকল ডকুমেন্টস পাঠাতে হবে। তারপর যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কনফার্মেশন পাঠায়, তাহলে আংশিক টিউশন ফি জমা দিতে হবে। কত টিউশন ফি ও কোথায় জমা দিতে হবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপনাকে জানিয়ে দিবে।
নিচে একটি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসের লিস্ট দেওয়া হলঃ
১। সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং মার্কশীট
২। মোটিভেশন লেটার ও রিকমেন্ডেশন লেটার
৩। ইউরোপাস ফরম্যাটে CV
৪। পাসপোর্টের কপি ও ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি
৫। আপ্লিকেশন ফি পরিশোধের রশিদ [ সাধারণত ৫০-৬০ ইউরো হয়ে থাকে এবং এই অর্থ ফেরৎযোগ্য নয় ]
সকল ডকুমেন্টস ঠিক ঠাক মত জমা দিতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেইল করে জেনে নিতে হবে।
পড়াশোনার খরচ ( টিউশন ফি)
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলোনায় এই দেশে টিউশন ফি অনেক কম। এই খানে সাধারণত টিউশন ফি ৯০০-৬,০০০ ইউরো পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাবজেক্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এই টিউশোন ফি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই আবেদন করার পূর্বে অবশ্যই টিউশন ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে দেখে নিতে হবে।
ব্যাচেলর, মাস্টার্স এইক্ষেত্রে ৯৫০ – ১২৫০ ইউরো প্রতি একাডেমিক ইয়ার।
পি এইচ ডির ক্ষেত্রে ২৫০০-৩৫০০ ইউরো প্রতি একাডেমিক ইয়ার।
পর্তুগালে আবাসন ব্যবস্থা
এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচে থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই, আগে ভাগে হোস্টেলে আবেদন করে দেওয়াই উত্তম।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে পর্তুগাল উন্নয়নে একটু পিছিয়ে আছে। তাই এই দেশে জীবন যাত্রার ব্যয় একটু কম। মাসে আপনি ৩০০-৩৫০ ইউরোতে খাওয়া থাকা মিটিয়ে ফেলতে পারেন।
আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ
ব্যাংক সলভেন্সি খুব ভালো হতে হবে । পর্তুগালে পড়তে গেলে আপনাকে ৬/৭ লক্ষ টাকা ব্যাংকে দেখাতে হবে। যে আপনার স্পনসর হবে তার সাথে আপনার সম্পর্ক কি কিংবা তার ইনকাম সোর্স কি সেগুলোর বেপারে যেন আপনি এমবাসির কাছে স্পষ্ট জবাবদিহি করতে পারেন সেটার জন্য তৈরি থাকতে হবে ।
স্পন্সরের একাউন্টে অস্বাভাবিক বড় মাপের লেনদেন হলে সেটার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হবে।
স্কলারশিপের সুযোগ আছে কি না?
পর্তুগালে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ। যা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারে। যেমনঃ Erasmus mundus Scholarship, এটা ইউরোপিয়ান উনিয়ন কর্তৃক প্রদত্ত উচ্চশিক্ষা বৃত্তি । সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস স্কলারশিপ হিসাবে গণ্য করা হয়। FCT Scholarship – Fellowships & Grants এটা পর্তুগালের খুব সম্মানজনক একটা বৃত্তি, পি এইচ ডি এবং পোস্ট ডক্টরেট এর জন্য এটা প্রদান করা হয় .প্রতি বছর ২৫০-৩০০ ফাইনাল আবেদন তারা নিয়ে থাকেন। বিস্তারিত জানতে তাদের ওয়েবসাইট কয়েক করুন – https://www.fct.pt/apoios/bolsas/concursos/ । তাছাড়া প্রতিটা ইউনিভার্সিটি তাদের Internal Scholarship এর ব্যাবস্থা করে থাকে। ভালো রেজাল্টের ভিত্তিতে আপনি সর্বোচ্চ ৫০%-৭৫% টিউশন ফি ছাড় পেতে পারেন।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে পর্তুগালের কোন এম্বেসী নেই- শুধু আছে কনস্যুলেট অফিস। তাই অবশ্যই আপনাকে ইন্ডিয়ার দিল্লীতে ভিসার জন্য যেতে হবে। আপনার সুবিধার্থে এম্বেসীর ঠিকানা ও ওয়েবসাইট নিচে দেওয়া হল।
https://www.novadeli.embaixadaportugal.mne.pt/en/
ডকুমেন্টস সত্যায়ন ও ভিসার আবেদন জমা – https://pt.vfsglobal.co.in/
দিল্লীস্থ পর্তুগালের এম্বেসীর ঠিকানাঃ
No.4, Panchsheel Marg, Block B, Diplomatic Enclave, Chanakyapuri, New Delhi, Delhi 110021, India
Phone: (91) 11 4607 1001 । Email: [email protected]
মনে রাখবেন, ভিসা জমা দেওয়ার পূর্বে আপনাকে একটি এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। এই ভিসা প্রাপ্তির জন্য ৩০ দিন সময় লাগে, তাই হাতে সময় রেখে কাজ শুরু করবেন। পড়াশুনা ও রিসার্চের জন্য আপনাকে লং টার্ম ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। এই লং টার্ম ভিসার মধ্যে আবার দুইটি প্রকারভেদ রয়েছে। একটি হলঃ টেম্পোরারী স্টে ও দ্বিতীয়টি হল রেসিডেন্স ভিসা। আপনাকে অবশ্যই লং টার্ম রেসিডেন্স ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
এবার জেনে নিন ভিসা আবেদনর জন্য কি কি ডকুমেন্টস প্রয়োজন পড়বেঃ
১। পূরণকৃত আবেদন ফর্ম ও ভিসা ফি প্রদানের রশিদ ৯০ ইউরো [স্কলারশিপধারীদের জন্য মওকুফ করা হয়]
২। পাসপোর্ট ও ফটোগ্রাফ (৩৫ মি.মি.x৪০ মি.মি. )
৩। CV, মোটিভেশন ও রেফারেন্স
৪।সকল মার্কশিট ও সনদ [অরিজিন্যাল ও সাথে ২ কপি ফটোকপি]
৫। No Objection Certificate [শেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে]
৬। অফার লেটার ও টিউশন ফি প্রদানের রশিদ
৭।অ্যাকোমোডেশন পেপ্যার
৮।ব্যাংক সলভেন্সি পেপ্যার
৯।৬ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট [ স্টেটমেন্টে ব্যাংক ম্যানেজারের স্বাক্ষর থাকতে হবে]
১০।পুলিশ ক্লিয়ারান্স
১১।হেলথ ইন্স্যুরেন্স
১২।One – way Flight Booking Copy
সব কিছু ঠিক থাকলে ভিসা পাওয়ার সম্ভবনা আনেক বেশি। বর্তমানে পর্তুগাল সরকার প্রচুর পরিমানে স্টুডেন্ট ভিসা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে। তাই বর্তমানে পর্তুগালে বিদেশী স্টুডেন্টের ঢলও নেমেছে।
মাসিক খরচ এবং পার্ট টাইম জব এর সুযোগ
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্তুগালে জীবন যাপন খরচ একটু কম। আপনি অনায়াসে এই দেশে ৩০০-৩৫০ ইউরোর মধ্যে খাওয়া- থাকা মিটিয়ে ফেলতে পারবেন। ৪০ ইউরো ট্রান্সপোর্ট খরচ প্রতি মাসে যা আপনার পুরো লিসবন জোন কভার করবে, ছাত্র হিসাবে আপনি গেলে আপনার জন্য ট্রান্সপোর্ট খরচ ৩০ ইউরো অনলি ।
আপনি এই দেশে পার্ট টাইম জবের সুযোগ পাবেন ২০ ঘন্টা/ সপ্তাহ। আর ছুটিতে পাবেন ফুল টাইম জব করার সুবিধা।পর্তুগীজ ভাষা জানা থাকলে জব পেতে বেগ পোহাতে হবে না। মনে রাখবেন, পর্ট টাইম জব করে থাকা খাওয়ার খরচ মেটাতে পারলেও টিউশন ফি জোগাড় করা সত্যিই কষ্টসাধ্য।
কোর্স শেষে চাকুরীর সুযোগ ও স্থায়ী বসবাস
পর্তুগালে বৈধভাবে ৫ বছরের বেশি বসবাস করলে আর ট্যাক্স, জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষদ ও আঞ্চলিক স্বাস্থ্য পরিষদে নিবন্ধন ও ভাষা জানা থাকলে আপনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একে Golden Residence Permit Program বলে।
আপনি পর্তুগালে স্টুডেন্টস ভিসায় আসলে রেসিডেন্স পার্মিট ইস্যুর তারিখ থেকে ৫ বছর থাকতে পারলে যে কোনো ক্যাটাগরিতে আপনি পি আর বা পর্তুগালের নাগরিকত্ব আবেদনের জন্য এলিজিবল হবেন।
তাহলে দেরী কেন? আবেদন করুন পর্তুগালে আজ ই।
তথ্যসুত্রঃ
১। https://www.bangladeshistudentscommunity.eu/archives/429
২। https://www.thedailycampus.com/study-abroad/16614/পর্তুগালে-উচ্চশিক্ষা-পেতে
৩। http://www.educationbangla.com/পর্তুগাল-হতে-পারে-উচ্চ-শিক্ষার-অর্জনে-নতুন-সম্ভাবনার-দ্বার/13274
৪। https://worldscholarshipforum.com/bn/low-tuition-universities-portugal-tuition-fees/
৫। http://studyinportugalfrombangladesh8.blogspot.com/2018/11/blog-post_50.html
৬। https://banglastudent.com/international/পর্তুগালে-উচ্চ-শিক্ষার-প/
৭। https://en.wikipedia.org/wiki/Portugal
৮।https://www.facebook.com/BsainEurope.eu/posts/3010317948983894/
লেখক/লেখিকা পরিচিতিঃ
সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল সমুহঃ
- স্টাইপেন্ডিয়াম হাঙ্গেরিকাম স্কলারশিপ - হাঙ্গেরিতে… হাঙ্গেরি ইউরোপের একটি অন্যতম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এটি মধ্যে ইউরোপের…
- ব্রেক্সিট–পরবর্তী নতুন নিয়মে যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসা ব্রেক্সিট–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাজ্যের সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার…
- রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ,নিজের আবেদন ইউরোপ-আমেরিকার ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের জন্য হয়ে ওঠে…
- আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষাঃ নিজেই করুণ, নিজের আবেদন নিজেই করুণ নিজের আবেদনের আজকের পর্ব সাজানো হয়েছে বিশ্বের অন্যতম…